
পদ্মা সেতুর পর দক্ষিণে আরেকটি স্বপ্নের সেতু, যেটিকে বলা হচ্ছে ‘নতুন অর্থনৈতিক করিডোর’ সেই ‘মধুমতি সেতু’ উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্কের এই সেতুটির কারণে নড়াইল, গোপালগঞ্জ, খুলনা, মাগুরা, সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা, যশোর ও ঝিনাইদহসহ এসব এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক অগ্রগতিও ত্বরান্বিত হবে। এটিকে বলা হচ্ছে আন্তর্জাতিক যোগাযোগে গুরুত্বপূর্ণ করিডোর। এই সেতুর কারণে কলকাতার সঙ্গে ঢাকা দূরত্ব অনেক কমলো।
সোমবার (১০ অক্টোবর) ভার্চুয়ালি সেতুটির উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এদিন দুপুরে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সেতুটির উদ্বোধন করেন তিনি।
এই সেতু যশোর-নড়াইলের পাশাপাশি বাংলাদেশকে সাব-রিজিনিওয়াল কানেক্টিভিটির মাধ্যমে মিয়ানমার ও ভারতের সাথে যুক্ত করবে। ফলে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় পরিবর্তনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প কর্মকর্তারা।

তারা জানান, জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে ৬৯০ মিটার দীর্ঘ সেতুটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৯৬০ কোটি টাকা। সেতুটি নড়াইল, গোপালগঞ্জ, খুলনা, মাগুরা, সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা, যশোর ও ঝিনাইদহ জেলাকে সংযুক্ত করেছে। এই সেতুর সরাসরি সুফল পাবে খুলনা বিভাগের ১০ টিসহ আরও কয়েকটি জেলার লাখ লাখ মানুষ।
তারা আরও জানান, সেতুটির কারণে ঢাকা থেকে নড়াইলের দূরত্ব কমে আসবে ১১৫ কিলোমিটার। আশপাশের অন্যান্য জেলার ক্ষেত্রে দূরত্ব কমবে ৯০-৯৮ কিলোমিটার। এই সেতু দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের যাতায়তে সময় ও অর্থ বাঁচাবে। এছাড়া দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোলের সঙ্গে ঢাকা চট্টগ্রামের দূরত্বও কমবে, সাশ্রয় হবে সময়। এর ফলে দেশের অভ্যন্তরে এবং প্রতিবেশি দেশে ভ্রমণ ও পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের সূচনা হবে।
নড়াইলসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করতে ২০০৮ সালে নড়াইলের সুলতান মঞ্চে নির্বাচনী জনসভায় কালনা ঘাটে এ সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি তিনি ‘কালনা সেতু’ নামে এ সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পরে কালনা সেতুর নাম পরিবর্তন করে নদীর নামে ‘মধুমতি সেতু’ নামকরণ করেন প্রধানমন্ত্রী।
নড়াইলের জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সেতুটি নির্মাণ করে দেওয়ার জন্য জেলাসহ এই অঞ্চলের মানুষের পক্ষে থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। এই সেতু পুরো দেশের আর্থ-সামাজিক, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভূত উন্নতি সাধন করবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সব অংশীজন, মধুমতি নদীর দুই পাড়ের ছাত্র-শিক্ষক, ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা অপেক্ষা করছিলো। সেতুটি তাদের জীবনমান বদলে দেবে।
ঢাকাসহ সারাদেশের যোগাযোগের ক্ষেত্রে নড়াইল হাব হিসেবে পরিচিতি পেতে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, দেশের ইতিহাসে সার্ভিসলেনসহ ৬ লেনের সেতু এটিই প্রথম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষকে উপহার দিয়েছেন এটি।
এদিন সড়ক ও জনপদের (সওজ) অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এবং প্রকল্প পরিচালক শ্যামল ভট্টাচার্য বলেন, আজ রাত ১২টায় যান চলাচলের জন্য জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে সেতুটি। ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্কের আওতায় ১৭টি সেতুর কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে এটি প্রথম চালু হচ্ছে।
এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল এশিয়ান হাইওয়েতে যুক্ত হওয়া- উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, এ ক্ষেত্রে সেতুটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এছাড়া পদ্মা সেতুর সুফল পুরোপুরি সুফল পেতেও এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এই অঞ্চলের স্থলবন্দরসহ অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্যও সেতুর কানেকশন জরুরি ছিল।
এই অঞ্চলের সাব-রিজিনিওয়াল কানেক্টিভিটি মিয়ানমার ও ভারতের সাথে বাংলাদেশকে যুক্ত করবে মধুমতি সেতু।
প্রকল্প পরিচালক শ্যামল ভট্টচার্য বলেন, ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক প্রকল্পের আওতায় সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। রাস্তাঘাট নির্মিত হবে অন্য প্রকল্পের মাধ্যমে। এটা একটা সাপ্লিমেন্টারী প্রজেক্ট। অন্যান্য যে প্রকল্প তৈরি হবে, তা এটার কমপ্লিমেন্টারী। ভাঙ্গা থেকে বেনাপোল পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প সাবমিট করা হয়েছে। সেটি হলে এই অংশের পুরোপুরি সুফলটা পাবো।
তিনি বলেন, মধুমতি সেতুর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো ধনুক আকৃতির দৃষ্টিনন্দন আর্টস টাইপ। সেতুতে ১৫০ মিটার স্প্যান রয়েছে, বড় স্প্যান দিয়েছি আমরা। যে ট্রেডিশনাল পিসি গার্ডার আই সেকশন দিয়ে ৪৫-৪৮ মিটারের বেশি বসানো যায় না। নদীর স্রোতধারা যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সে জন্য আর্টস টাইপ স্প্যান দেওয়া হয়েছে। এর ফলে নৌ চলাচলের কোন সমস্যা নেই।
মধুমতি সেতু পারাপারের জন্য বড় ট্রাক ৫৬৫টাকা, তিন বা ততধিক এক্সসেলের ট্রাক ৪৫০টাকা, দুই এক্সসেলের মাঝারি ট্রাক ২২৫ টাকা, ছোট ট্রাক ১৭০ টাকা, কৃষি কাজে ব্যবহৃত পাওয়ার ট্রিলার ও ট্রাক্টর ১৩৫ টাকা, বড় বাস ২০৫ টাকা, মিনিবাস বা কোস্টার ১১৫ টাকা, মাইক্রোবাস, পিকাপ, রূপান্তরিত জিপ ও রেকার ৯০ টাকা, প্রাইভেটকার ৫৫ টাকা, অটো টেম্পো, অটোরিকশা, অটোভ্যান ও ব্যাটারিচালিত তিন চাকার যান ২৫টাকা, মোটরসাইকেল ১০ টাকা এবং রিকশা, ভ্যান ও বাইসাইকেলে পাঁচ টাকা করে টোল দিতে হবে।
এই সেতু প্রকল্প ২০১০ সালে একনেকে অনুমোদন পেলেও ২০১৮ সালের ২৮ জানুয়ারি নির্মাণকাজ শুরু হয়। সেতু নির্মাণে ৬০৮.৫৬ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। এর মধ্যে ২৬৩.৩৬ কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকারের তহবিল থেকে এবং ৩৪৫.২০ কোটি টাকা সৌদি ফান্ড ফর ডেভেলপমেন্ট (এসএফডি) থেকে এসেছে।
ওয়াকওয়েসহ সেতুটিতে ৩৮টি স্প্যান রয়েছে। পাঁচটি নদীতে এবং ৩৩টি পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে। হাঁটার পথসহ সেতুটির প্রস্থ ২২.১৫ মিটার। এছাড়া, ছয়লেনের টোল প্লাজা এবং দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ অ্যাপ্রোচ রোডও নির্মাণ করা হচ্ছে।